২০১৮-র জুলাই-আগস্ট। শরীর জানান দিচ্ছে গোলমাল ঘটে গিয়েছে ভিতরে ভিতরে অনেকটাই। তবু নাছোড় তিনি। সকাল থেকে রাত পড়ে আছেন হাসপাতালে। স্ত্রী জানতে চাইছেন, শরীরের এই অবস্থায় এত দৌড়াদৌড়ি ঠিক হচ্ছে? নির্বিকার মুখে হাসি রেখেই মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে হাসপাতাল-ঘর করে চলেছেন। জ্বর এলেও গাড়িতে শুয়েই পৌঁছে যাচ্ছেন হাসপাতালে। রোগী দেখার ফাঁকে সেখানেই সারছেন বিশ্রাম। তবু স্বপ্ন থেকে টেনেহিঁচড়েও সরানো যাচ্ছে না তাঁকে! স্বপ্নটা বুনেছিলেন সেই ১৯৯৮ থেকে। তখন মুম্বইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় দিনানিপাত করছেন ডাঃ আশিস মুখোপাধ্যায়। তাগিদ একটাই। এখান থেকে যা কিছু শিখে নেবেন, তা থেকেই কলকাতায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত রোগীদের পরিষেবা দেবেন। নিজে হেমাটো-অঙ্কোলজিস্ট হওয়ায় রক্তমজ্জা বদলানো বা বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনের খরচ যে কতখানি, বিলক্ষণ জানতেন তিনি। তাই গরিব মানুষ যাতে সেই পরিষেবা নামমাত্র খরচে পান, সেই স্বপ্নের পিছনেই আজীবন ধাওয়া করছিলেন। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বিদেশ থেকে ডিগ্রির সুযোগ ও বিপুল অর্থের চাকরির প্রস্তাব। সময়ও তাঁর সঙ্গে শঠতা করেনি। কলকাতায় ফিরে নিজের রাজ্যের গরিব মানুষদের কম খরচে বোনম্যারো ও কর্ড ব্লাড ট্রান্সপ্লান্টেশন করেন কোঠারিতে চাকরি নিয়েই। একপ্রকার তাঁর শর্ত মেনেই কোঠারি এক বছরের মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি করে দেয়। তবে আরও কম, আরও ন্যূনতম অর্থে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের পরিষেবা দেওয়ার কথা ভাবতে থাকেন ডাঃ মুখোপাধ্যায়। ততদিনে তাঁর নাম ও কর্মদক্ষতার কথা ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ থেকে মহাকরণ পর্যন্ত। মন্ত্রীরাও মন দিয়ে শোনেন তাঁর স্বপ্নের কথা। সেই স্বপ্ন— হবে এমন এক হাসপাতাল, যেখানে একই ছাদের তলায় ক্যান্সারের চিকিৎসার বহুমূল্য ব্যয়ভারের খরচ সামলাতে পারবেন দিন-আনি-দিন খাই মানুষগুলিও। পার্কস্ট্রিটের পড়ে থাকা নার্সিংহোমটার কথা শোনামাত্রই প্রয়োজনীয় কথাবার্তা, কাজকর্ম চালিয়ে তাকে নতুন রূপদান করলেন। নাম দিলেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ক্যান্সার রিসার্চ ইনস্টিটিউট। তবে সেখানে শুধু রোগী দেখাই নয়, ক্যান্সার নিয়ে প্রয়োজনীয় গবেষণার পরিকাঠামোও তৈরি করেছিলেন। কয়েকজন আরএমও ছাড়া বাকি সকল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই স্রেফ আশিসবাবুর অনুরোধে নামমাত্র পারিশ্রমিকে সেখানে পরিষেবা দিতেন। বহু নিম্ন-মধ্যবিত্ত রোগীই পার্কস্ট্রিটের এই হাসপাতালে দীর্ঘ দিন ধরে খুব কম খরচে বোনম্যারো ও কর্ড ব্লাড ট্রান্সপ্ল্যানটেশন সহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেয়েছেন। এদিকে অক্লান্ত পরিশ্রম সইতে সইতে শরীর ক্রমে ভাঙতে শুরু করেছে। তবু স্বপ্ন থেকে যাচ্ছিল অধরা। একই ছাদের তলায় গোটা একটা ক্যান্সার ইউনিট আর হয়ে উঠছিল কই! সেই তাড়না থেকেই নিজের শারীরিক সমস্যাকে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না। এমন একটা সময়ে নয়াবাদে একটি একতলা বাড়ির হদিশ পান আশিসবাবু। সেই একতলা বাড়িতেই গোটা একটি ক্যান্সার ইউনিট গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। পাশে মানসিক শক্তি জোগাতে সবসময় পাশে পান স্ত্রী সোমা মুখোপাধ্যায়কে। নিজের যাবতীয় সঞ্চয় উজাড় করে ২০১৮’র মে মাস নাগাদ সেই নয়াবাদের বাড়িকেই রূপান্তরিত করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ক্যান্সার হসপিটালে। লক্ষ্য একটাই। একজন রোগীও যেন চিকিৎসা পেতে এসে অর্থের অভাবে ফিরে না যান। এদিকে তেড়ে জ্বর আসছে মাঝেমধ্যেই। তবু কাজ পাগল মানুষটি নিরন্তর ডুবে যাচ্ছেন ক্যান্সার গবেষণায়। স্ত্রীর জোড়াজুড়িতে অবশেষে নিজের চিকিৎসায় মন দিলেন। তখনই হাতে এল মারাত্মক সেই রিপোর্ট। যে অসুখ নিয়ে এতদিন ব্যস্ত থেকেছেন, সেই মারণ ক্যান্সারই তলে তলে বাসা বেঁধেছে তাঁর গলব্লাডারে। তবে দেরি হয়ে গিয়েছে অনেকটাই। অসুখ গলব্লাডার ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে লিভারেও। নিজেই বুঝতে পারছিলেন, জীবন আর বেশিদিন সময় দেবে না। তাই দ্রুত বসলেন মিটিংয়ে। নিজের অবর্তমানে ১৫০ শয্যার সেই হাসপাতালে কোন বিভাগে কে কাজ করবেন, কার কোন বিভাগে নতুন কী কী দায়িত্ব পড়বে, সেই কাজও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। শুধু কাজে নয়,জীবনের সংলাপেও ছিলেন এতটাই পরিকল্পনাপ্রবণ। কেমন তা? ‘ভয় পাচ্ছি খুব, সকলে বলছেন, তোমাকে ভেন্টিলেশনে দিতে হতে পারে। কী করব তখন...’ স্ত্রীকে মাঝপথে থামিয়েই বলেলেন, ‘আমাকে ভেন্টিলেশনে দিতে হবে না। তার আগেই...।’ শিউরে উঠলেন স্ত্রী। ‘তার আগেই কী!’ মৃদু হেসে বলেন, ‘কী আর হবে, একটা একটা করে অঙ্গ জবাব দেবে। এই তো মাত্র! তার জন্য এত কষ্ট করে করা কাজ কিন্তু তোমরা হারিয়ে ফেলো না। বরং সামলে রেখো।’ স্বামীর উত্তরে হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন স্ত্রী। মৃত্যু এসে কড়া নাড়ছে জানার পরেও এত নিরুত্তাপ, এত নির্বিকার থাকে কী করে কেউ! তারপরও দরকারে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে, নিজের চিকিৎসা চলাকালীনও নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন কাজে। রোগীদের সমস্যা ক্যান্সারের তীব্র যন্ত্রণাও তাঁর মস্তিষ্ককে আটকে রাখতে পারেনি। আটকে গেলেন ২৬ জানুয়ারি, ২০২০। দিন চারেক আগেই পার করেছেন নিজের ৫৭ বছরের জন্মদিন। সারাজীবনের চর্চার অসুখ কেড়ে নিল প্রাণ! তবে মৃত্যুহীন জীবন যাঁরা বয়ে আনেন, তাঁরা নশ্বর হলেও কাজ থেমে থাকে না। আজও তাঁর আদর্শমেনেই নয়াবাদের ওই হসপিটাল দরিদ্র রোগীর সেবায় নিরন্তর সজাগ। রোগীদের মুখে মুখেই সেই স্বপ্ন বুনছেন আশিস মুখোপাধ্যায়। অনেক দূর থেকে যেন দেখা যাচ্ছে এক অন্য আকাশ। সে আশমানে ক্যান্সারের দাগ নেই। আছে শুধু স্বপ্নপূরণের রং। লিখেছেন মনীষা মুখোপাধ্যায়